আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন পড়াশুনা কাজকর্ম জন্ম স্থান?
-বাংলাদেশী কালচারে দেশের বাড়ি বলে দাদার ভিটাবাড়ির বিষয় বুঝানো হয়ে থাকে, সেই দিক থেকে আমার দেশের বাড়ি বরিশাল ; জন্মস্থান আমার নানা বাড়ি টাঙ্গাইল। তবে ৯ বছর বয়সে পরিবারের সাথে ইতালি চলে যাই এবং সেখানেই পড়াশুনা শেষ করি ও জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছি। আমি নিজেকে সবসময় একজন ইতালিয়ান বাংলাদেশী হিসেবেই বিবেচনা করি। বাংলাদেশকে জন্মস্থান হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসি, ইতালির প্রতিও মাতৃভূমির মতোই টান অনুভব করি।
ইতালিতে আমি মেটালার্জি নিয়ে পড়াশুনা করেছি (বিভিন্ন মেটাল এর প্রোডাকশন ও পিউরিফিকেশন নিয়ে গবেষণা) এবং বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করছি। এখানে আমার একটি ব্যবসা রয়েছে।
আপনার ভ্রমণের এই বিশাল সংখ্যাটি কীভাবে সম্ভব হলো?
-ছোট বেলা থেকেই ভ্রমন ছিলো আমার জীবনের অনেক বড় একটি প্যাশন যেটি সময়ের সাথে সাথে এডিকশনে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে আমি ট্র্যাভেল কে শুধুমাত্র প্যাশন হিসেবে দেখিনা। ট্র্যাভেল কে আমি আমার জীবনের মৌলিক চাহিদা হিসেবে দেখি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন মৌলিক কিছু বিষয় প্রয়োজন, একইভাবে আমার জন্যও ট্র্যাভেল একটি এসেনশিয়াল বিষয়। আমার ইনকাম থেকে সমস্ত সেভিংস আমি ট্র্যাভেল এর পিছনেই খরচ করি। যখনই কিছু টাকা জমে সাথে সাথে সব খরচ করে ফেলি কোনো একটি ট্যুরে গিয়ে।|
এত দেশ ভ্রমণের পেছনে মূল অনুপ্রেরণা কী ছিল?
-ইতালিতে প্রতি রবিবার বিকেল ৫ টায় “Alle falde del Kilimangiaro” নামে একটি প্রোগ্রাম হতো। সেই সময় ইউটিউব কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ছিলোনা। টিভিই ছিলো একমাত্র ইন্টারটেইনিং। সেই প্রোগ্রামে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্থানের সৌন্দর্য দেখানো হতো। আমি একটি ক্লাবে ফুটবল খেলতাম ; রবিবার সকাল ১০ টায় আমাদের লীগ ম্যাচ থাকতো। ম্যাচ থেকে বাসায় এসে এতো ক্লান্ত থাকতাম যে দিনের বাকি অংশ পুরোটাই কাটাতাম সোফায়। দুপুর ৩ টায় ইতালিয়ান লীগ Serie A এর ম্যাচ দেখতাম, সেই ম্যাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে যেতো সেই ট্র্যাভেল প্রোগ্রামটি। আমার ছাত্রজীবনে এমন একটি রবিবার যায়নি যেই রবিবার আমি সেই প্রোগ্রামটি মিস করেছি। সেই প্রোগ্রমকেই বলবো আমার অনুপ্রেরণা। সেই প্রোগ্রাম যখন দেখতাম তখন সবসময় চিন্তা করতাম যে যখন টাকা কামাবো তখন আমিও এভাবে বিশ্ব ভ্রমণ করবো।
২০২৪ সালে আপনি যে নতুন দেশ গুল ভ্রমণ করেছেন, তার মধ্যে কোন দেশটি সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে এবং কেন?
-২০২৪ সালে যেই কয়টি দেশ ভ্রমণ করেছি তার মধ্যে সবথেকে বেশি মুগ্ধ হয়েছি ওমান দেখে। এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে আমি চিন্তা করেছি যদি কখনো ইংল্যান্ড কিংবা ইতালির বাহিরে অন্য কোনো দেশে বসবাসের চিন্তা করি তাহলে সেটি হবে ওমান। সবথেকে বেশি যেই বিষয়টি ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে ওমানের রিল্যাক্সিং লাইফ : কারো যদি ১০০০-১৫০০ ইউএস ডলারের মাসিক ইনকাম সোর্স থাকে তাহলে ওমানের মত এতো সুন্দর, নিরাপদ এবং ফ্রেন্ডলি দেশ হয়তো আর নেই। আপনি মন চাইলেই সমুদ্রে গিয়ে গোছল করতে পারবেন আবার ২ ঘন্টা পরেই পাহাড় হাইক করতে পারবেন। ওমানে রয়েছে বিশ্বের সবথেকে সুন্দর সুন্দর ওয়াদি যেখানে গোসল করার অনুভূতি অতুলনীয়। রয়েছে বিশাল বড় বড় ডিউনের মরুভূমী , সালালাহ তে রয়েছে সবুজ প্রকৃতি। সব কিছু মিলিয়ে ওমান আমাকে সত্যিই অনেক ইমপ্রেস করেছে।
পুরনো দেশগুলোর মধ্যে কোন দেশটির প্রতি পুনরায় ভ্রমণের কারণ কী ছিল?
-২০২৩ সালে আমি এবং আমার দুই বন্ধু মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে সাউদি ভ্রমণ করেছিলাম এবং প্রত্যেকেই সেই ট্যুর এতো বেশি উপভোগ করেছিলাম যে ২০২৪ সালে পুনরায় গিয়েছি। সাউদি আমার মতে বিশ্বের সবথেকে আন্ডাররেটেড এবং অপরিচিত দেশ গুলোর একটি। বাংলাদেশের মানুষ সাউদি বলতে শুধুমাত্র মাক্কাহ কিংবা মাদীনার মত পবিত্র ভূমি অথবা লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাসস্থান হিসেবেই চিনে। কিন্তু সাউদি কতটা সুন্দর সেই সম্পর্কে কম মানুষই ধারণা রাখে। সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে আল উলা রিজোন। আমি মনে করি আল উলা শুধু সাউদিই নয়, সমগ্র বিশ্বের মধ্যেও সবথেকে সুন্দর স্থানগুলোর একটি। দুটি ট্যুরেই আমরা গাড়ি ভাড়া করে নিজেরাই ড্রাইভ করে ঘুরেছি। গোটা অভিজ্ঞতাই এতো সুন্দর ছিলো যে ডেফিনিটলি আমরা ভবিষ্যতেও সাউদিতে ঘুড়তে যাবো।
আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা কীভাবে তৈরি করেন?
-দৈনন্দিন জীবনে আমি খুব অগুছালো হলেও ভ্রমণের ক্ষেত্রে আমি খুবই অর্গানাইজড। একটি ট্যুর করতে গেলে সেই ট্যুর এর প্রতিটি বিষয় আমি নোট করে রাখি। সেখানকার কালচার, ইতিহাস, খাবার, সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। এক শহর থেকে আরেক শহরে ট্রান্সফার সম্পর্কে ডিটেইলস জানার চেষ্টা করি। কোনদিন কোথায় যাবো, কয়টার সময় কোথায় থাকবো সবকিছু আমার প্ল্যান করা থাকে। এমনকি ২/৩ টি প্ল্যান ও করে রাখি যাতে করে প্ল্যান ১ কোনো কারণে এক্সেকিউট করতে ব্যার্থ হলে প্ল্যান ২ কিংবা ৩ রেডি থাকে। এভাবে প্ল্যান করতে আমি খুব পছন্দ করি। আমি মনে করি ট্যুর যেমন আনন্দনীয় একটি বিষয়, একইভাবে সেই ট্যুর গুছানোটাও কম আনন্দের নয়। ইতালিয়ান খুব ফেমাস এক কবি Giacomo Leopardi বলেছিলেন, la vera gioia è nell’attesa di ciò che pensiamo ci renderà felici অর্থাৎ সত্যিকারের আনন্দ হচ্ছে সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করা যেই মুহূর্তকে আমরা আনন্দ হিসেবে গণ্য করে থাকি।
বাজেট এবং সময় ব্যবস্থাপনা কীভাবে করেন?
-আমার ইনকাম থেকে যত সেভিংস থাকে পুরোটাই কিংবা ৮০% খরচ হয়ে যায় ট্র্যাভেলের পিছনে। যেহেতু নিজের কাজ, তাই সময় ব্যাবস্থাপনা করতে খুব একটা কষ্ট হয়না।
ভ্রমণে গিয়ে কোনো দেশ বা স্থানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন কি?হয়ে থাকলে কীভাবে তা সামলেছেন?
-সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো আমার মৌরিতানিয়া ট্যুর। আমি ওপরেই বলেছি যে সাধারণত আমার প্রতিটা ট্যুর পর্যন্ত প্ল্যান করা থাকে। কিন্তু মৌরিতানিয়ার ক্ষেত্রে একদমই ভিন্ন ছিলো। প্রথমত মৌরিতানিয়া সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য অনলাইনে পাওয়া যায়না। দ্বিতীয়ত হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে ট্রান্সপোর্ট গুলোও আগে থেকে বুক করার কোনো উপায় নেই। যার কারণে মৌরিতানিয়া আমি যাই অনেকটাই এই চিন্তা করে যে “আগে যাই, তারপর একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে”. কি কি স্থান ঘুরবো সেই প্ল্যান থাকলেও কিভাবে ঘুরবো কোথায় থাকবো, কত টাকা লাগবে এমন কোনো কিছুই পরিকল্পিত ছিলোনা। সেখানে যাওয়ার পর মানুষের সাথে কথা বলে বলে প্ল্যান বাস্তবায়ন করেছি এবং মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে আতিথেয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ কোনটি ছিল?
-প্রতিটি দেশেই কম-বেশি ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে আতিথিয়তা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের কথা বললে আমি যেই ৩/৪ টি দেশের নাম বলবো সেগুলো হচ্ছে : বসনিয়া,উজবেকিস্তান, ওমান এবং জর্দান।
কোন দেশটি আপনার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি? এর কারণ কী বলে মনে করেন?
-আরব আমিরাত : দেশটির কিছুই ভালো লাগেনি। আমার মতে বিশ্বের সবথেকে ওভাররেটেড ডেস্টিনেশন। একজন ট্র্যাভেলার হিসেবে একটি দেশে গিয়ে আমি যা দেখতে চাই, করতে চাই কিছুই পাইনি। স্থানীয় কালচার বলতে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। স্থানীয়দের সাথে মেশার কোনো উপায় নেই। স্থানীয় সবাই ধরাছোঁয়ার বাহিরে। হিউমান রিলেশন বলতে যা কিছু হবে সবকিছুই হবে বাহিরের দেশের মানুষের সাথে। তাছাড়া আমি মডার্ন আর্কিটেকচার একদমই পছন্দ করিনা, এটাও একটি কারণ আরব আমিরাত ভালো না লাগার পিছনে। দুবাইর মত শহরকে রীতিমত একটি জাইগান্টিক থিম পার্কের মত মনে হয়েছে যেখানে কোটিপতিরা যায় একটু সময় কাটাতে আর টাকা খরচ করতে। একজন ট্র্যাভেলার হিসেবে দুবাই যাওয়ার পিছনে কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
ভ্রমণের সময় স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা, বা খাদ্য নিয়ে কোনো মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল কি? এত ভ্রমণের মধ্যে কোন মুহূর্তটি সবচেয়ে স্মরণীয় বলে মনে হয়? কেন?
-আমি যখন কোথাও ভ্রমণে যাই তখন সবসময় সম্ভব হলে স্থানীয় পোশাক পড়ার চেষ্টা করি, কয়েকটি স্থানীয় শব্দ বলার চেষ্টা করি এবং শুধুমাত্র স্থানীয় খাবার খাই। আমি মনে করি একটি দেশের কালচার বুঝার জন্য এবং তাদের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্মরণীয় ঘটনা তো অনেক রয়েছে তবে একটি ঘটনা যদি বলতে হয় তাহলে জর্দানের একটি ঘটনা সবসময়ই মনে পরে। পেত্রার পাশে ওয়াদি মুসা নামক একটি গ্রামে ছিলাম। বিকেল বেলায় একা একা হাটতে বের হয়েছিলাম, রাস্তার পাশেই একটি বিয়ের প্রোগ্রাম হচ্ছিলো। আমাকে একা হাটতে দেখে স্থানীয় একজন আমাকে তাদের সাথে ইনভাইট করলো। সেখানে তাদের সাথে খেলাম। তারপর তাদের একজন আমাকে একটি ফাইভ ষ্টার হোটেলে নিয়ে গেলো চা-কফি আপ্পায়নের জন্য। সবশেসে একজন ড্রাইভার দিয়ে আমাকে হোটেলেও পৌছিয়ে দিলো।
মৌরিতানিয়া মতো তুলনামূলক কম পরিচিত দেশগুলোর সংস্কৃতি এবং মানুষ কেমন লেগেছে?
-মৌরিতানিয়া তে যাওয়ার আগে মনের ভিতরে কিছুটা ভয় ছিলো সেফটি নিয়ে। সাধারণত গরিব দেশগুলোতে সিটি সেন্টারের বাহিরে রাতের বেলায় সেফটি ইস্যু থাকে। কিন্তু মৌরিতানিয়া গিয়ে আমি অবাক হয়েছি যে এমন একটি গরিব দেশেও প্রতিটি জায়গা কত নিরাপদ। মানুষজন খুবই ধার্মিক। নামাজের সময় হলে রাস্তার আসে-পাশে দেখা যায় অসংখ নামাজের দৃশ্য। দোকানদাররা নামাজের সময় দোকানের সামনেই নামাজ আদায় করে নেয়। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ পুরো কিংবা ৫০% কুরআনের হাফেজ। গাড়িতে বাসে চড়লে খুবই কমোন একটি দৃশ্য যে পাশের মানুষ হয়তো মোবাইলে কুরআনের চর্চা করছে।
আপনার ভ্রমণে নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হয়েছিল কি? হলে তা কীভাবে মোকাবিলা করেছেন?
-জেরুজালেম শহরের ঐতিহাসিক অংশটি অর্থাৎ যেখানে আল আকসা মসজিদ অবস্থিত সেখানে প্রবেশের প্রতিটি দরজা ইজরাইলি সৈন্য দ্বারা ঘেরাও করা। ওয়েস্ট ব্যাংক অর্থাৎ বর্তমানের মূল ফিলিস্তিন থেকে আল আকসা আসতে হলে চেক পয়েন্ট পার হতে হয়। বাসে করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে জেরুজালেম যাচ্ছিলাম। জেরুজালেমে প্রবেশের আগে একটি চেক পয়েন্টে ইজরাইলি সৈন্যরা আমাদের বাস থামালো সবার ডকুমেন্টস চেক করার জন্য। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের যদি ইজরায়েলে কাজ করার ওয়ার্ক পারমিট না থাকে তাহলে তারা জেরুজালেম প্রবেশ করতে পারেনা। বিষয়টি স্বচক্ষে না দেখলে কখনো হয়তো জানতামনা। আমি যেহেতু ব্লগ করি তাই সৈন্য যখন বড় বড় অস্ত্র নিয়ে বাসে প্রবেশ করছিলো তখন সেটি ভিডিও করার চেষ্টা করি এবং বিষয়টি এক সৈন্য দেখে ফেলে। সাথে সাথে আমার দিকে কিছুটা আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে এবং যা ভিডিও করেছি সেটি ডিলেট করে দেয়ার জন্য বলে। অতঃপর আমার পাসপোর্ট নিয়ে যায় এবং সবার ডকুমেন্টস চেক করার পর আরো কিছুক্ষন আমার পাসপোর্ট তাদের কাছে রেখে তারপর ফিরত দেয় এবং সাবধান করে দেয় যে এই ধরণের ভিডিও যেনো আর কখনো না করি। সেই মুহূর্তে সত্যিই অনেক ভয় পেয়েছিলাম।
কোন দেশের খাবার আপনার সবচেয়ে প্রিয় লেগেছে? এবং কোন খাবারটি একেবারেই পছন্দ হয়নি?
-আমি মিডল ইস্টার্ন এবং মেডিটেরানিয়ান ফুডের অনেক ভক্ত। ইতালিয়ান ফুড গুলো অতুলনীয়। মরোক্কান ডিশও আমার খুবই পছন্দনীয়। মরোক্কান ফেমাস ডিশ কুসকুস আমি এতো পছন্দ করি যা ভাষায় বুঝানো সম্ভব নয়। আমার ওয়াইফ প্রায় সময়ই এটি রান্না করে থাকে। জার্মানির টার্কিশ কাবাব গুলোও অসাধারণ। জার্মানিতে যেই টার্কিশ কাবাব পাওয়া যায় এটি আর কোথাও দেখিনি। তবে আমার কাছে ওয়ার্ল্ড এর বেস্ট ফুড হচ্ছে সাউদির রোমানসিয়া রেস্টুরেন্ট এর ল্যাম্ব খাবসা। শুধুমাত্র রোমানসিয়ার এই খাসির মাংসের খাবসা খাওয়ার জন্য হলেও প্রতি বছর সাউদি যেতে চাই। কয়েক মাস আগে আমরা তিন বন্ধু মিলে সাউদি গিয়েই প্রথম যাই রোমানসিয়া তে খাবসা খেতে। সুবহান আল্লাহ ! কি সেই স্বাদ ; মনে হচ্ছিলো যেনো জান্নাত থেকে এসেছে।
নর্থার্ন ইউরোপিয়ান দের খাবার সাধারণত ভালো হয়না ; তাদের খাবার এতই বাজে যে তারা নিজেরাও এখন আর তাদের খাবার খায়না। তারা সাউথ ইউরোপিয়ান ফুডকেই নিজেদের ফুড বানিয়ে নিয়েছে। যেহেতু অর্থনৈতিক ভাবে তারা বিশ্বের সবথেকে স্বচ্ছল জাতি সুতরাং তাদের পক্ষে এটি সম্ভবও হয়েছে।
ভ্রমণের সময় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনা কী ঘটেছিল?
-তেল আবিব এয়ারপোর্টে ঘটেছিলো সবথেকে বিরক্তকর ঘটনা। মুসলিম হিসেবে প্রচন্ড ডিস্ক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছি। প্রথমত একটি কাউন্টার থেকে একটি কোড নিতে হয় এবং সেই কোড অনুযায়ী আপনার সাথে আচরণ করা হবে। প্রতিটি জায়গায় সবাই দাঁড়াতো একটি লাইনে আর আমি এবং আরেকজন মুসলিম দাঁড়াতাম আরেকটি লাইনে। আমার ব্যাগ খুলে প্রতিটি জামা কাপড় একটি একটি করে চেক করেছে, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন প্রতিটি বিষয় নিয়ে চেক করেছে। জুতা মুজা খুলিয়ে চেক করেছে এবং কারণ ছাড়াই এক ঘন্টার বেশি সময় বসিয়ে রেখেছে। এটাই আমার জীবনের সবথেকে অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
তবে সত্য বলতে তেল আবিব শহরে আমি খারাপ কোনো আচরণ পাইনি। বরঞ্চ সবাই অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলো এবং সাহায্যপরায়ন ছিলো।
আপনার মতে নতুন ভ্রমণকারীদের কোন তিনটি গুণ থাকা প্রয়োজন?
-প্রথম যে গুণ প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ফ্লেক্সিবিলিটি, কোথাও ঘুরতে গেলে সবসময় প্রতিটি ক্ষেত্রে ফ্লেক্সিবল হওয়া জরুরি। ঘুরতে গেলে ১৯/২০ হতেই পারে সেগুলোকে গায়ে নেয়া যাবেনা।
ওপেন মাইন্ড -নতুন দেশের কালচার, ভাষা, খাবার, মানুষ, পোশাক, ধর্ম সকলের প্রতি সম্মান রেখে চলা উচিত।
সময়ের জ্ঞান – সব কাজ সময় মত করা খুব জরুরি। সময়ের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একটি স্থানে দেরি হলে পুরো ট্যুর প্ল্যান টাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সবসময় সময়ের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
আপনি কি একা ভ্রমণ করেন, নাকি কোনো গ্রুপের সঙ্গে?
-একা ভ্রমণই বেশি করি। তবে বছরে ২ টি ট্যুরে আমার স্ত্রী অথবা ছোট বোন কিংবা দুইজনই থাকে। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথেও ট্র্যাভেল করি।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবকিছু নিজ হাতে প্ল্যান করতে পছন্দ করি। এটাও আমার কাছে ট্র্যাভেলের মতোই একটি আনন্দনীয় বিষয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ট্যুর গ্রুপের সাথেই যেতে হয়, সেক্ষেত্রেও আমি নিজেই সেগুলো খুঁজে বুক করে থাকি।
একা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন?
-চমৎকার ; একা ভ্রমণই আমার সবথেকে পছন্দের। ভ্রমণ বলতে আমি শুধু সুন্দর একটি জায়গা দেখে সেখানে কিছু ছবি তুলে চলে আসাকেই বুঝিনা। এগুলোও ভ্রমণের অংশ তবে এর সাথে আরো অনেক কিছু রয়েছে : যেমন স্থানীয়দের সাথে গল্প করা, তাদের কালচার সম্পর্কে জানা-বুঝা, নতুন নতুন বন্ধু বানানো এই ধরণের অনেক কিছুও ভ্রমণের অংশ। এই বিষয়গুলো শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন আপনি একা থাকবেন।
যেসব দেশে বারবার গিয়েছেন, সেসব দেশে আবার ভ্রমণের পরিকল্পনা আছে কি?
-অবশ্যই ! সাউদি, ওমান নিঃসন্দেহে আবার যাবো। তুরস্ক আরেকটি রাষ্ট্র যেখানে পুনরায় যাওয়ার অনেক ইচ্ছা পোষণ করি। তারপর আইসল্যান্ডে পুনরায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিবেচনা করলে আইসল্যান্ড হয়তো আমার দেখা সবথেকে সুন্দর দেশ। তবে যেই দেশটি ভ্রমণ করতে সবথেকে বেশি সময় যেতে হবে সেটি হচ্ছে ইতালি। ইতালিতে এতো কিছু রয়েছে দেখার মত যে ৫০ বার গেলেও সবকিছু দেখে শেষ করা সম্ভব নয়।
ভ্রমণের সময় প্রযুক্তি কীভাবে আপনাকে সাহায্য করে? বিশেষ কোনো অ্যাপ বা টুল ব্যবহার করেন?
-বর্তমানে আমরা সবাই কম-বেশি প্রযুক্তি নির্ভরশীল। প্রতিটি কাজেই আমাদের কম-বেশি প্রযুক্তির শরণাপন্ন হতে হয়। ট্র্যাভেল এর ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম নয়। হোটেল বুকিং গুলো “বুকিং” এর এপ থেকেই করে থাকি। কখনো কোনো ট্যুর বুক করতে হলে “গেট ইউর গাইড” এপ ব্যবহার করা হয়। গুগল ম্যাপস তো রয়েছেই যেটি হয়তো সবথেকে বেশি হেল্পফুল এবং ব্যবহৃত এপ।
প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণকারীদের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেবেন?
-যারা প্রথমবার দেশের বাহিরে ট্র্যাভেল করতে যাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে বলবো যেখানেই যান সেখানকার পরিবেশ ও মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। আপনার প্রতিটি কাজ আপনার দেশকে বাহিরের দেশের মানুষের কাছে মেলে ধরে। সুতরাং এমন ভাবে নিজেকে মেলে ধরুন যাতে করে বাহিরের দেশের মানুষ আপনার দেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে।
ভ্রমণে সবচেয়ে ভালো এবং বাজে অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিতে পারবেন?
-ঐভাবে বাজে কোনো অভিজ্ঞতা এখনো হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। তবে সবথেকে ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা যদি বলি তাহলে বলবো মৌরিতানিয়ার আয়রন ট্রেন জার্নি। সাহারার মধ্যে দিয়ে ২০ ঘন্টার একটি লম্বা জার্নি যেখানে এই ২০ ঘন্টা থাকতে হয় কয়লার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে। লাইফটাইম একটি এক্সপেরিয়েন্স ছিলো। এবং আমিই হয়তো প্রথম বাংলাদেশী যে কিনা এই যাত্রাটি করতে পেরেছে। সুতরাং একটি গর্বেরও বিষয় আমার জন্য।
আপনার ভবিষ্যৎ ভ্রমণ পরিকল্পনা কী?
-প্রথমত বিশ্ব ভ্রমণ চালু রাখা। এমন কোনো টার্গেট নেই যে বিশ্বের সবগুলো দেশই দেখতে হবে, তবে ভালো লাগার প্রতিটি স্থানই দেখতে চাই।
দ্বিতীয়ত আমি চাই ভবিষ্যতে ভ্রমণ সংক্রান্ত কিছু করতে যাতে করে ভ্রমণটাকেই আমি আমার আয়ের উৎস বানাতে পারি।
এমন কোনো দেশ আছে যা এখনো আপনার তালিকায় রয়েছে?
-জি অবশ্যই ! আমার বাকেট লিস্টে অনেক দেশ রয়েছে। আপাতত যদি কোনো দেশের নাম জানতে চান তাহলে আমার আগামী ট্যুর এর দেশগুলোর কথাই বলছি। আগামী বছর আমি প্রথমবারের মত ল্যাটিন আমেরিকা যাচ্ছি ইনশা আল্লাহ। লন্ডন থেকে প্রথমে যাবো চিলি, তারপর চিলি থেকে বলিভিয়া, অতঃপর বলিভিয়া থেকে পেরু এবং পেরু থেকে রিটার্ন। ২২ দিনের একটি বড় সফর হবে। খুবই এক্সাইটেড রয়েছি, যদিও ট্যুর এর এখনো অনেক দিন বাকি।
ট্রাভেল বিষয়ে আপনার নিজে থেকে বলতে চান বা গ্রুপের মেম্বারদের জনাতে চান যা নতুনদের ট্রাভেলের বিষয়ে ভ্যালুএ্যাড করবে জানাতে পারেন।
-আপনারা যারা ট্র্যাভেল করতে সক্ষম নিজেদের প্রিভিলেজড হিসেবে গণ্য করুন। অসংখ মানুষ আছে যাদের ভাগ্যে এই সুযোগ আসেনা। কারো কাছে ভ্রমণের জন্য টাকা নেই, কারো কাছে টাকা আছে কিন্তু সময় নেই, কারো টাকা সময় সবই আছে কিন্তু সাস্থ নেই। আল্লাহ আপনাকে টাকা, সময় এবং সাস্থ সব দিয়েছেন সুতরাং শুকরিয়া করুন এবং এই সুযোগকে সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগান। ভ্রমণকে শুধুমাত্র ছবি তোলা আর ভিডিও করার মাঝেই সীমিত না রেখে শিক্ষণীয় করে তুলুন। ভ্রমণের মাধ্যমে নিজের জীবনকে সুন্দর করুন, নিজের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করুন।